বিজেপির সাংগঠনিক অচলাবস্থায় রাজনৈতিক গতি বাড়াচ্ছে সিপিআইএম ও কংগ্রেস!
রাজ্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির আবহে আপাতত হিমঘরে পাঠানো হয়েছে বিজেপির প্রদেশ সভাপতি নির্বাচন। যদিও দুই দেশের মধ্যে এখন সাময়িক যুদ্ধবিরতি চলছে, তবুও বর্তমান পরিস্থিতিকে যুদ্ধকালীন বলেই চিহ্নিত করছে রাজনৈতিক মহল। এই পরিস্থিতিতে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বও মুখ খুলতে পারছেন না—কবে হবে সভাপতি নির্বাচন, তা স্পষ্ট নয় কারও কাছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জুয়েল ওরাং এখনও পর্যন্ত রাজ্যে পা রাখেননি। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে বর্তমান বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ফলে রাজ্য নেতৃত্ব কার্যত বল ঠেলে দিয়েছে দিল্লির কোর্টে এবং তারা নিজেরাও ‘সুখনিদ্রা’য় নিমগ্ন, অভিযোগ দলের অভ্যন্তরেই।
প্রসঙ্গত, এবছরের এপ্রিল মাসের গোড়ায় সংসদের বাজেট অধিবেশন শেষ হওয়ার পরেই বিভিন্ন রাজ্যে তড়িঘড়ি সভাপতি নির্বাচন শুরু হয়েছিল। কিন্তু সূত্রের খবর, নতুন সর্বভারতীয় সভাপতির বিষয়ে আরএসএস ও মোদী-অমিত শাহের মধ্যে মতানৈক্যের কারণে পুরো প্রক্রিয়াই আবার জটিল হয়ে পড়ে। বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সভাপতি নির্বাচনও আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তা নিয়ে আর আলোচনা নয় বলেই দলীয় মহলের দাবি। দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যে নতুন সভাপতি না হওয়ায় গোটা সংগঠন কার্যত ছন্নছাড়া অবস্থায় পৌঁছেছে। রাজ্য নেতাদের মুখে এখন আর সভাপতি নির্বাচন নিয়ে তেমন আগ্রহ বা উদ্দীপনা নেই। সাংবাদিক সম্মেলনেও এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে নেতারা অস্বস্তিতে পড়ছেন, কারণ পুরো বিষয়টি এখন দিল্লির অধীন।
তৃণমূল স্তরের সংগঠন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। আজও রাজ্যের ৪০ শতাংশের বেশি বুথে সভাপতি নির্বাচন হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পুরনো নেতারাই সেই বুথ পরিচালনা করছেন। কিছু মণ্ডলে সভাপতি নির্বাচিত হলেও কমিটি গঠন হয়নি। একই চিত্র জেলা কমিটিগুলিতেও। নতুন জেলা সভাপতি নির্বাচনের পরেও বহু জায়গায় জেলা কমিটি গঠিত হয়নি। রাজ্যে এখন প্রদেশ, জেলা, মণ্ডল—সব পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো স্থবির। মাঝে মধ্যে বৈঠক হলেও শাখা সংগঠনগুলো কার্যত নিষ্ক্রিয়। মহিলা মোর্চা, যুব মোর্চা, ওবিসি মোর্চা, এসসি মোর্চা, জনজাতি মোর্চা এবং কিষাণ মোর্চা—প্রায় প্রতিটি শাখা সংগঠনেই নতুন নেতৃত্ব নেই। এর জেরে নেতাদের মধ্যে কোনও কর্মচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে না।
এই যুদ্ধের আবহে কেন্দ্রের নির্দেশে রাজ্যজুড়ে ‘তেরঙ্গা যাত্রা’র মতো দেশপ্রেম জাগানো কর্মসূচি পালন করছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘মন কি বাত’ও নিয়মিত সম্প্রচার হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সংগঠনের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে রাজ্য নেতাদের তেমন কোনও উৎসাহ নেই। কেবল কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করেই দায় সারা হচ্ছে। এই অচলাবস্থার সুযোগ নিচ্ছে সিপিএম ও কংগ্রেস। কংগ্রেসের ‘সংবিধান বাঁচাও’ কর্মসূচি ইতিমধ্যেই রাজ্যে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। অন্যদিকে সিপিএম তাদের রাজ্য কমিটির বৈঠকে লড়াই-সংগ্রাম আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুব সংগঠন তিন দফা দাবিকে সামনে রেখে রাস্তায় নেমে পড়েছে বহু আগেই।
নতুন সভাপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় রাজ্য বিজেপির অভ্যন্তরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এতদিন মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব কোনও গোষ্ঠী না থাকলেও এখন তাঁর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী লবি তৈরি হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন কর্মসূচিতে মুখ্যমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে প্রশংসার বন্যা বইছে। এতে দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজন তৃণমূল স্তরের কর্মীদের মধ্যেও প্রভাব ফেলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র দেখা যাচ্ছে জনজাতি মোর্চা এবং ওবিসি মোর্চার ক্ষেত্রে। পাহাড় এখন পুরোপুরিভাবে তিপ্রা মথার উপর নির্ভরশীল। বিজেপির পাহাড়ের অফিসগুলো একে একে গুঁড়িয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছেন কর্মী ও কার্যকর্তারা। জনজাতি মোর্চাকে রাজনৈতিক মহল ‘কোমায়’ বলেই উল্লেখ করছে।
রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব, জনজাতি মোর্চাকে উপেক্ষা করে তিপ্রা মথাকে গুরুত্ব দেওয়ার যে কৌশল নিয়েছে, তার ফলেই সংগঠনের ভিত্তি তলানিতে এসে ঠেকেছে বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। একই চিত্র ওবিসি মোর্চার ক্ষেত্রেও। ওবিসি সংরক্ষণ ইস্যু দানা বাঁধলেও কার্যত দল কিছুই করতে পারেনি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আগামী বিধানসভা ভোটেও বিজেপিকে আঞ্চলিক দল—তিপ্রা মথা ও আইপিএফটি’র উপর নির্ভর করেই ভোট বৈতরণি পার করতে হতে পারে। যা শাসক দলের জন্য অত্যন্ত অস্বস্তিকর বিষয়।
সবমিলিয়ে, রাজ্য বিজেপির অন্দরেই এখন সাংগঠনিক শূন্যতা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, জনভিত্তির অবনতি ও কর্মী-সমর্থকদের মনোবলহীনতা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। এমন অবস্থায় দলকে টেনে তুলতে হলে দ্রুত নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং কার্যকর সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কোনো বিকল্প নেই—এমনটাই মত রাজনৈতিক মহলের। অন্যথায়, রাজ্যে শাসক দল হিসেবে বিজেপির ভবিষ্যৎ বড়সড় সংকটে পড়তে পারে বলে অভিমত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।