নার্সিং স্টাফরা দীর্ঘ বঞ্চনার শিকার

নার্সিং পেশাকে মানবতার সেবার নাম দিয়ে ঠকানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে!

ত্রিপুরার স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করতে ৪৩২ জন নার্স  নিয়োগে বড়সড় পদক্ষেপ নিল রাজ্য সরকার। এর মধ্যে ৩৩২ জন নিয়মিত নার্সিং অফিসার হিসেবে এবং অতিরিক্ত ১০০ জন চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের কথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডঃ মানিক সাহা আগরতলার রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনে আন্তর্জাতিক নার্সেস দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন।

এই অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নার্সিং একটা অত্যন্ত সম্মানজনক ও দায়িত্বপূর্ণ পেশা। রোগী যখন হাসপাতালে আসে, তখন প্রথমে তার পাশে দাঁড়ান নার্সরা। তাঁরা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে শুরু করে মানসিক সাহচর্য দিয়ে থাকেন। সেবার মধ্য দিয়েই নার্সরা রোগীর মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলেন।” মুখ্যমন্ত্রী জানান, “২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে আগরতলা নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটকে ‘আগরতলা গভর্নমেন্ট নার্সিং কলেজ’-এ উন্নীত করা হয়েছে। এখন রাজ্যেই বিএসসি নার্সিং, এমবিবিএস ও বিডিএস-এর মত উচ্চমানের কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে ছেলেমেয়েরা।” তিনি আরও জানান, উদয়পুরের ৪০ আসন বিশিষ্ট এএনএম প্রতিষ্ঠানকে জিএনএম কোর্সে উন্নীত করা হয়েছে। এছাড়া দুর্জয়নগরের নার্সিং ইনস্টিটিউটের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে। নার্সিং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটাতে একাধিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য পরিষেবায় গুণগত পরিবর্তন আনতে ইতিমধ্যেই ২০২৪ সালে রাজ্যে ১৫৩ জন নার্স নিয়োগ হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। বর্তমানে রাজ্যে ৯টি সুপার স্পেশালিটি চিকিৎসা পরিষেবা চালু হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিসেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি এবার রাজ্যে বেসরকারি লগ্নিকারীরাও বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, যা এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। ডাঃ সাহা এদিনের বক্তব্যে নার্সদের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানসিক সুস্থতার দিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, “এই পেশার সঙ্গে যুক্তদের প্রতি আমাদের আরও যত্নশীল হতে হবে।

এবারের আন্তর্জাতিক নার্সেস দিবসের থিম — ‘আমাদের নার্সগণ আমাদের ভবিষ্যৎ, নার্সদের যত্ন নিন, অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করুন’ — অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।” তিনি বলেন, “নার্সদের মাধ্যমে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান সম্ভব হলে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কাঠামোও আরও মজবুত হবে।” তবে এক শ্রেণীর নার্সদের মতো এই ধরনের থিম প্রতি বছরেই করা হয়, তবে এই স্লোগান গুলি শুধুমাত্র অনুষ্ঠানের পেছনের ব্যানারেই শোভা পায় এবং আদতে এগুলির কোন প্রয়োগই নেই।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নার্সিং জগতের পথপ্রদর্শক ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিনেই সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক নার্সেস দিবস পালন করা হয়। তাঁর জন্ম ১৮২০ সালের ১২ মে। ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ নামে যাঁকে সবাই চেনে, তিনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আহত সৈনিকদের অক্লান্ত সেবা করেছিলেন। তাঁর দেখানো পথেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি।” এদিনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা মন্ত্রী শ্রী টিংকু রায়, স্বাস্থ্য সচিব কিরণ গিত্যে, স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডাঃ তপন মজুমদার, পরিবার কল্যাণ ও রোগ প্রতিরোধ অধিকর্তা ডাঃ অঞ্জন দাস, মেডিকেল এডুকেশনের অধিকর্তা ডাঃ এইচ পি শর্মা, ত্রিপুরা নার্সিং কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার রেবেকা ডার্লং সহ রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তরের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্তা ও বিশিষ্টজনেরা।

কিন্তু ঐদিনের অনুষ্ঠানে ডাক্তার মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের নার্সিং স্টাফদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং প্রতিকূলতা নিরসনে কোন সদিচ্ছা বা আলোচনা শোনা যায়নি। যেখানে ত্রিপুরা রাজ্যে অন্যান্য সব বিভাগে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একের পর এক পদোন্নতির ঘোষণা ও বাস্তবায়ন হয়েছে, সেখানে দীর্ঘদিন ধরেই নার্সিং স্টাফদের জন্য কোনও স্পষ্ট পদোন্নতি হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী নিজে একজন চিকিৎসক হয়েও এই সংক্রান্ত বিষয়ে অনুষ্ঠানে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি—এই বিষয়টি নিয়ে চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ রাজ্যের নার্স সমাজ। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী অনেক নার্স আশা করেছিলেন, একজন ডাক্তার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ডাঃ মানিক সাহা তাঁদের বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করবেন এবং অন্তত পদোন্নতি বা গ্রেড পরিবর্তনের বিষয়ে কোনও ঘোষণা করবেন। কিন্তু সেই আশায় কার্যত জল ঢেলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

বর্তমানে ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই নার্সিং কর্মীদের গ্রুপ ‘বি’ পদমর্যাদায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ ত্রিপুরায় আজও নার্সিং স্টাফরা গ্রুপ ‘সি’ তে রয়ে গেছেন। শুধুমাত্র তাঁদের পদের নাম পরিবর্তন করে ‘নার্সিং অফিসার’ বলে ডাকলেই বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন হয় না—এমনটাই মত নার্স সংগঠনগুলির। অনেকেই মনে করছেন, এটি একপ্রকার চাতুর্যপূর্ণ চাল মাত্র, যাতে প্রকৃত উন্নতির পরিবর্তে শুধু নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে।

আরও হতাশাজনক বিষয় হলো, কিছুদিন আগে কেন্দ্র সরকার থেকে নার্সদের পোশাক ভাতা প্রদানের বিষয়ে একটি নির্দেশিকা জারি হওয়ার পর রাজ্যের অর্থ দপ্তর সেই ভাতা অনুমোদন করলেও পরে তা আবার বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে নার্সরা দিনরাত ২৪ ঘণ্টা নিরলস পরিষেবা দিয়ে থাকেন, সেখানে তাঁদের প্রতি এই অবহেলা ও বঞ্চনা একপ্রকার অবিচার বলে মনে করছেন সমাজের বিশিষ্টজনেরা। তাঁদের মতে, একজন ডাক্তার মুখ্যমন্ত্রীর উচিত ছিল এই পেশার সম্মান রক্ষায় এবং দীর্ঘদিনের বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। মুখ্যমন্ত্রীর এই নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তাই নার্সদের ন্যায্য দাবিকে আরও দীর্ঘসূত্রিতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।About Us