টিএনজিসিএলের গ্রাহক প্রতারণার ফাঁদ

টিএনজিসিএলকে মনোপলি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তকমা!

ত্রিপুরা রাজ্যে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা টিএনজিসিএল (ত্রিপুরা ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড) একাধিক অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে। বাড়ি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কিংবা যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজি—সব ক্ষেত্রেই সংস্থাটির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বিলিং, স্বচ্ছতার অভাব এবং একচেটিয়া মনোভাবের অভিযোগ তুলে ধীরে ধীরে ক্ষোভ জমছে সাধারণ জনগণের মধ্যে। ডমেস্টিক বা গৃহস্থালির গ্যাস সংযোগে গ্রাহকরা প্রতিনিয়ত অভিযোগ করছেন অতিরিক্ত বিল সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে। জানা গেছে, বর্তমানে মিনিমাম বিলের পরিমাণ ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে, যেখানে অনেক সময় মিটার ঘোরার পরিমাণও যথেষ্ট কম থাকে। মিটার একটু বেশি ঘুরলেই বিলের অংক যেন আকাশ ছোঁয়া হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে, বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রেও অভিযোগের অন্ত নেই। সংস্থার তরফে একতরফাভাবে নিয়ম চাপিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, এখন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ই-বিল পাঠানো হবে এবং কাগজের বিল বন্ধ করা হবে। গ্রাহকরা যদি ই-বিল না পান, তাহলে কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করতে হবে এবং তিন দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। গ্রাহকদের অভিযোগ বিল হাতে না পেয়েও পেনাল্টি হিসেবে ২ শতাংশ অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। টিএনজিসিএল-এর সিএনজি পরিষেবাও ক্রমশ জনসাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিছুদিন পরপরই দাম বাড়ছে সিএনজির, এমনকি অনেকে আশঙ্কা করছেন, সিএনজির দাম পেট্রোলের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে খুব শীঘ্রই। যা পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবস্থার ওপর একটি বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হলো টিএনজিসিএলের মাধ্যমে আরোপিত ‘ত্রিপুরা রোড ট্রান্সপোর্ট সেস’। এই খাতে প্রতি মাসে ১৯.৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। তার উপর রয়েছে আরও ৪ শতাংশ ভ্যাট। গ্রাহকদের প্রশ্ন, এই ‘রোড ট্রান্সপোর্ট সেস’ আদায় করে টিএনজিসিএল কী ধরনের সুবিধা দিচ্ছে রাজ্যবাসীকে? ট্যাক্সের এই অস্বচ্ছ ব্যবস্থার কারণে মনে করা হচ্ছে, টিএনজিসিএল এখন শুধুই একটি বাণিজ্যিক সংস্থা হিসেবে কাজ করছে, যার মূল উদ্দেশ্য লাভজনক ব্যবসা—পরিষেবা নয়। বছর শেষে যদি প্রতিটি গ্রাহক ১৯.৫ শতাংশ হারে সেস প্রদান করেন, তাহলে সেই অংক দাঁড়ায় লক্ষ লক্ষ টাকায়। এই অর্থের হিসাব কোথায়, কাদের কাছে এবং কোন খাতে তা ব্যয় হচ্ছে—তা নিয়ে নেই কোনো স্বচ্ছতা।

টিএনজিসিএল ডিজিটাল লেনদেন উৎসাহিত করতে বলেছে, যারা অনলাইনে বিল মেটাবেন, পরবর্তী বিলে তাদের ৫০ টাকা ছাড় দেওয়া হবে। কিন্তু এই ছাড়ে তেমন উপকার পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। অনেকের মত, লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করে মাত্র ৫০ টাকার ছাড় দিয়ে টিএনজিসিএল আসলে একটি প্রহসন করছে। টিএনজিসিএল যখন রাজ্যে যাত্রা শুরু করে, তখন তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পরিবেশবান্ধব সমাজ গঠনের। তারা বলেছিল, গ্যাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ ত্রিপুরা গড়ে তোলা হবে, যার মাধ্যমে জ্বালানির নিরাপদ ও সহজলভ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হবে। রাজ্য সরকার ও আসাম সরকারের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা আজ এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে জনগণের মধ্যে মনে হচ্ছে, তারা যেন সুদখোর মহাজনের মতো আচরণ করছে।

টিএনজিসিএলের সেবায় প্রতিযোগিতা না থাকার ফলে সংস্থাটি একপ্রকার মনোপলি ব্যবসা চালাচ্ছে রাজ্যে। নেই বিকল্প সংস্থা, নেই প্রতিদ্বন্দ্বী পরিষেবা প্রদানকারী। এই একাধিপত্যের সুযোগে তারা ইচ্ছামতো নিয়ম চাপিয়ে দিচ্ছে এবং গ্রাহকদের অসুবিধার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই করছে না। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, টিএনজিসিএল বর্তমানে একটি প্রভাবশালী বাণিজ্যিক সংস্থায় পরিণত হয়েছে, যারা গ্রাহকদের কথা ভাবার বদলে কেবলই মুনাফার হিসেব কষছে। প্রশ্ন উঠছে—এমন অবস্থা চলতে থাকলে রাজ্যের সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? সরকারের উচিত এই সংস্থার কার্যক্রমের উপর নজরদারি করা এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সব অভিযোগ খতিয়ে দেখা। জনগণের করের টাকা দিয়ে চলা একটি সংস্থা যদি জনগণকেই ঠকায়, তাহলে সেই ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত—সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।About Us