যুদ্ধের আগুনে পকেট গরম অসাধু ব্যবসায়ীদের

যুদ্ধের আতঙ্কে নিত্যপণ্যের বাজারে চাহিদা ও মূল্য উভয়ই ঊর্ধ্বমুখী!

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আবহ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ত্রিপুরা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এক ধরনের অজানা আতঙ্ক। সেই আতঙ্কের সরাসরি প্রভাব পড়েছে রাজ্যের বাজারঘাটে। একদিকে যেমন সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুত করতে দোকানে দোকানে ভিড় করছেন, অন্যদিকে সুযোগ বুঝে কিছু সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী বাড়িয়ে দিচ্ছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম।
রাজধানী আগরতলার অন্যতম বৃহৎ পাইকারি ও খুচরো বাজার মহারাজগঞ্জ-সহ অন্যান্য বাজারগুলিতে গত কয়েকদিন ধরেই নজরে পড়ছে বাড়তি ভিড়।

বিশেষত বুধবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি বড় শহরে প্রত্যাঘাতের খবর সামনে আসতেই সেই আতঙ্ক আরও বাড়ে। শুক্রবার সকাল থেকে বাজারগুলিতে দেখা গেছে সাধারণ মানুষ হুড়োহুড়ি করে চাল, ডাল, তেল, ময়দা, ডিম, শাক-সবজি, মাছ-মাংস, এমনকি জরুরি ওষুধ পর্যন্ত কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। মহারাজগঞ্জ বাজারের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গেছে, যুদ্ধের পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকেই পোল্ট্রির ডিমের দাম প্রতি পেটিতে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। পাশাপাশি চালের দামও প্রতি কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই যুদ্ধকালীন এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কিছু ব্যবসায়ী কৃত্রিম ভাবে সংকট তৈরি করে অধিক মুনাফার লক্ষ্যে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে।

এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, প্রশাসন কি করছে? এখনও পর্যন্ত রাজ্য সরকারের তরফে বাজারে কোনো নজরদারি শুরু হয়নি। নেই কোনো নির্দেশিকা বা বিশেষ তৎপরতা। নেই বাজার অভিযান, নেই মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। অথচ পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করেই এই সময়ে প্রশাসনের সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল। যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সেই দিকেই প্রশাসনিক নজরদারির প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।

যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তা অনেকটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে করোনাকালীন লকডাউনের আগের সময়টিকে। ঠিক যেমনভাবে মানুষ তখন আতঙ্কে চাল, ডাল, তেল, ওষুধ মজুত করতে শুরু করেছিল, তেমনই এখন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এই আশঙ্কায় অনেকে বাড়িতে ২ থেকে ৩ মাসের রসদ মজুত করতে শুরু করেছেন। এমন অনেক পরিবারকে দেখা গেছে যারা তিন থেকে চার মাসের চাল, ডাল, সরিষার তেল, বিস্কুট, শুকনো খাবার এমনকি পানীয় জল পর্যন্ত সংগ্রহ করছেন।

মহারাজগঞ্জ বাজারের এক ব্যবসায়ীর কথায়, “কেউ কেউ এমনও আছেন যারা একসাথে ২৫-৩০ লিটার সরিষার তেল নিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সাধারণত ওই পরিবারে মাসে ৩-৪ লিটারের বেশি তেল লাগে না। ওষুধের দোকানেও ভিড় অনেক বেড়েছে। যাঁদের প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়, তাঁরা ৩-৪ মাসের স্টক নিচ্ছেন।” এই মজুতদারি শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ নেই, জেলা শহরগুলির বাজারেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। উত্তর, দক্ষিণ, গোমতী, ধলাই— প্রায় সব জেলাতেই বাজারে অস্বাভাবিক চাহিদা বেড়ে গেছে।

এই পরিস্থিতিতে বড় প্রশ্ন উঠে আসছে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া শ্রেণির মানুষদের জীবনযাত্রা নিয়ে। যেখানে একসঙ্গে দুই থেকে তিন মাসের খাদ্যসামগ্রী কিনে রাখার সামর্থ্য নেই, সেখানে যুদ্ধকালীন মূল্যবৃদ্ধি তাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে। দিন আনি দিন খাই পরিবারের কাছে এই পরিস্থিতি দুর্বিষহ। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, “আমরা তো দৈনিক আয় করেই চাল-ডাল কিনে খাই। যুদ্ধ হলে যদি কাজ বন্ধ হয়ে যায়, যদি জিনিসের দাম নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে পরিবার নিয়ে বাঁচব কীভাবে?” রাজ্য খাদ্য দপ্তরের আধিকারিকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাজ্যে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী মজুত আছে। সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বাস্তবে বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও কৃত্রিম সংকটের আভাস ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

সাধারণ মানুষের প্রশ্ন—যদি এত মজুত থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন কেন? প্রশাসনের তরফ থেকে এখনো পর্যন্ত বাজারে কোনো অভিযান শুরু হয়নি। কোথাও মূল্য তালিকা যাচাই হচ্ছে না। নেই জরিমানা, নেই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য এটি হয়ে উঠছে সোনার সুযোগ। যুদ্ধের আগুনে পকেট ভরাচ্ছেন তারা। অথচ প্রশাসন এখনো নীরব দর্শকের ভূমিকায়। সারা রাজ্যে পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে চাপা ক্ষোভ ক্রমেই জমে উঠছে। কিছু বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সংগঠন ইতিমধ্যেই প্রশাসনের নির্লিপ্ততার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। তাদের বক্তব্য, “যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মানুষ আতঙ্কিত—কিন্তু সরকার চোখ বন্ধ করে বসে আছে। বাজারে নজরদারি নেই, অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে।”

বর্তমানে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হলো, যদি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে রাজ্যের পরিস্থিতি কী হবে? বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্য হিসেবে ত্রিপুরা যে স্ট্র্যাটেজিকেলি গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদি পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে ভারতের উপর প্রত্যাঘাতের চেষ্টা করে, তবে সীমান্ত রাজ্য হিসেবে ত্রিপুরার ওপর প্রভাব পড়া অবশ্যম্ভাবী।

এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই সাধারণ মানুষ আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, যুদ্ধ যদি তিন থেকে চার মাস গড়ায়, তাহলে পণ্য আমদানি বন্ধ হতে পারে, সীমান্তে সমস্যা দেখা দিতে পারে, রাজ্যে সংকট তৈরি হতে পারে। এমন অবস্থায় পরিবারকে বাঁচাতে এখনই মজুত বাড়াতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত—মানুষকে আশ্বস্ত করা এবং বাজারে নজরদারি জোরদার করা। সঠিক দামে বাজারে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যুদ্ধ একদিকে দেশের জন্য সংকট, অন্যদিকে কিছু অসাধুর জন্য লোভের উৎস। সাধারণ মানুষ যাতে সেই লোভের শিকার না হন, তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব।About Us