ককবরক ভাষার হরফ আন্দোলনে কংগ্রেসের সমর্থন

ককবরক ভাষার জন্য রোমান হরফ চালুর দাবিকে হাতিয়ার করে পাহাড়ের রাজনীতিতে কংগ্রেস!

ককবরকে রোমান হরফে লেখার দাবিতে বিশাল মিছিল করে শিক্ষা ভবনে স্মারকলিপি জমা দেন আদিবাসী কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা। দাবির সপক্ষে আরও তীব্র আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তারা। এতদিন যেই দাবিতে তিপরা মথা সরব ছিল, সেই একই দাবি নিয়েই এবার রাজনীতির ময়দানে হাজির কংগ্রেসের উপজাতি শাখা।

১২৫ বছরের পুরনো কংগ্রেস পার্টি দীর্ঘদিন ধরেই পাহাড়ে সংগঠন বিস্তারে ব্যর্থ। স্বাধীনতা-উত্তর কালে উপজাতি ভোটব্যাঙ্ক দখলে কখনো টিইউজিএস, কখনো আইএনপিটি, আবার কখনো আইপিএফটির কাঁধে ভর করেছে কংগ্রেস। ১৯৮৮ সালে বামফ্রন্ট সরকারের পতনের পরে উপজাতি যুব সমিতির (টিইউজিএস) সহযোগিতাতেই সরকার গঠন করেছিল কংগ্রেস। কিন্তু টিইউজিএস-র মনোমালিন্যের কারণেই সুধীর মন্ত্রিসভা ভেঙে পড়ে। পরে সমীর রঞ্জন বর্মনের নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন মন্ত্রিসভা। এরপরও একাধিকবার পাহাড়ে নিজেদের সংগঠন বিস্তারে জনজাতিভিত্তিক দলগুলির সঙ্গে জোট গড়েছে কংগ্রেস, তবে মাটির মানুষের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছে। আদিবাসী কংগ্রেস গঠন করেও রাজনৈতিক জমি শক্ত করতে পারেনি পাহাড়ে।

যে রোমান হরফের দাবিতে এতদিন তিপরা মথা রাজপথে আন্দোলন করছিল এবং বিধানসভায় সরব হচ্ছিল, এবার সেই একই দাবিকে সামনে রেখে সংগঠন বাড়ানোর কৌশল নিচ্ছে কংগ্রেস। তিপরা মথার প্রধান প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মা মাঝে মাঝে ভিডিও বার্তা দিয়ে কর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেও, মাঠে সংগঠন ধরে রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই সুযোগেই রোমান হরফের দাবিকে সামনে এনে সংগঠন বিস্তারে ঝাঁপাল আদিবাসী কংগ্রেস।

এই প্রেক্ষাপটে ফের সামনে এসেছে ককবরক ভাষার লিপি বিতর্ক। রাজ্য সরকার ভাষার উন্নয়নে একাধিকবার কমিটি গঠন করলেও, ফল প্রকাশ হয়নি আজও। বর্তমান বনমন্ত্রী তথা তিপরা মথার নেতা অনিমেষ দেববর্মা প্রশ্ন তুলেছিলেন, যারা ককবরক জানেন না, তারা কীভাবে ভাষার উন্নয়নে কাজ করবেন? বাম জমানায় গঠিত তিনটি ভাষা কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন পবিত্র সরকার, প্রয়াত শ্যামাচরণ ত্রিপুরা ও কুমুদ কুন্ডু চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। কিন্তু সেই সময়েও লিপি প্রসঙ্গে কোন স্থায়ী সিদ্ধান্ত হয়নি।

বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং তাদের জনজাতি মোর্চা স্পষ্ট করে জানিয়েছে, রোমান হরফ চালুর বিরোধিতায় তারা অনড়। বিজেপির নেতাদের মতে, ককবরক ভাষার হরফ নিয়ে বিদেশি চক্রান্ত চলছে। তাই কোনও বিদেশি হরফে ভাষা চালু হওয়া উচিত নয়। যতদিন পর্যন্ত ককবরকের নিজস্ব হরফ তৈরি না হচ্ছে, ততদিন দেবনাগরী হরফেই ভাষা চালু থাকবে বলেই তারা মত দিয়েছেন। তাদের মতে, দেবনাগরী হরফ ভগবানের সৃষ্টি। তাই তা “ভগবানের ভাষা।” ইতিমধ্যেই অরুণাচল প্রদেশ ও আসামের বড়োল্যান্ডে দেবনাগরী হরফ চালু হয়েছে — ত্রিপুরাও ঠিক সেই পথেই এগুচ্ছে।

কিন্তু রোমান হরফকে ঘিরে যে আবেগ তিপ্রাসা জনগণের মধ্যে রয়েছে, সেটাকেই এবার পুঁজি করতে চাইছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের নেতাদের মতে, বাংলা বা দেবনাগরী নয় — রোমান হরফই হতে হবে ককবরকের ভবিষ্যৎ। এই আবেগকে ঘিরেই পাহাড়ে নিজেদের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আদিবাসী কংগ্রেস। রোমান হরফ নিয়ে রাজনীতি যত এগোচ্ছে, ককবরক ভাষার ভবিষ্যৎ ততই অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। এই লিপি-যুদ্ধ যে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে, তা আর অজানা নয়। আদিবাসী কংগ্রেস কতদূর যেতে পারবে এই দাবিকে সামনে রেখে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।About Us