হাওড়া নদীর নাব্যতা ও যৌবন বৃদ্ধির প্রকল্প হিমঘরে!
হোয়াংহো যদি চীনের দুঃখ হয়, তবে সমকালীন ত্রিপুরায় হাওড়া নদী তার যৌবন হারিয়ে এখন যেন আগরতলাবাসীর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বর্ষার মৌসুমে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। অবাধে বন ধ্বংসের ফলে পাহাড়ের মাটি ও বালি বৃষ্টির জলের সঙ্গে নেমে এসে নদীতে জমা হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকায় নদী তার স্বাভাবিক রূপ ও যৌবন হারিয়েছে, এবং ভয়াবহভাবে হ্রাস পেয়েছে নাব্যতা। এই পরিস্থিতির ফলে শহরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
হাওড়া নদীর দু’পাশে সৌন্দর্যায়নের কাজ চললেও নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা এখনও হিমঘরে। শহরবাসীর বক্তব্য, সৌন্দর্যায়নের কাজ চলতে থাকলেও নদীর প্রকৃত যৌবন ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে সবার আগে। নদীর পাড় বাঁধাইয়ের পাশাপাশি ফুলের বাগান তৈরি করা গেলেও, নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এর ফলে বৃষ্টি হলে শহরের জল নদীতে প্রবাহিত না হয়ে উল্টো নদীর জল শহরে ঢুকে পড়ে। শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ড বৃষ্টির জলে প্লাবিত হয়, যার ফলে সাম্প্রতিক কালে গোটা আগরতলা শহর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে ২০১৮ সালে বিজেপি-আইপিএফটি জোট রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে চম্পকনগর সাধুপাড়ায় হাওড়া নদীর উৎসস্থল পরিদর্শনে যান। পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল যে, নদীর উৎস মুখে জল সংরক্ষণের জন্য জলাশয় খনন করা হবে। প্রায় ২০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শহরবাসী যেমন বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেত, তেমনি পানীয় জলের ব্যবস্থাও আরও উন্নত হতো। এতে বর্ষার অতিরিক্ত জল আটকে রাখা সম্ভব হতো এবং শহর আগরতলাকে বন্যা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দেওয়া যেত। একইসঙ্গে হাওড়া নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি ও প্রকৃত যৌবন ফিরিয়ে আনার জন্য বালি ও মাটি তুলে নেওয়ার পরিকল্পনাও ছিল।কিন্তু সময় গড়ালেও এই প্রকল্প এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারের সাত বছরের শাসনকাল অতিক্রান্ত হলেও এই প্রকল্পের কাজ ঝুলেই রয়েছে। শহরবাসীর মনে প্রশ্ন জেগেছে, আদৌ কি এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে? নাকি এটি শুধুই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল?তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব আগরতলাবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বৃষ্টির জল নিষ্কাশনের জন্য আধুনিক নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়ন করবেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতিও বাস্তবে পরিণত হয়নি।
হাওড়া নদীর উৎসমুখে জলাশয় খননের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল শহরবাসীকে নিরাপদ ও পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা। বর্তমানে আগরতলা শহরে যে পানীয় জল সরবরাহ করা হয়, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে। শহরের প্রধান জলের উৎস হাওড়া নদী হলেও নদীর দুই তীরে ছড়িয়ে থাকা কৃষি জমিগুলোতে প্রতিনিয়ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। ফলে নদীর জল দূষিত হয়ে পড়ছে, যা শুধু ক্লোরিন দিয়ে পরিশোধন করা সম্ভব নয়। এই সমস্যা সমাধানে বড়মুড়া পাহাড়ের পাদদেশে একটি জলাশয় খনন করে সেখানে প্রাকৃতিক উপায়ে জল পরিশোধনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। পরিশ্রুত এই জল পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন হয়নি।
এই অবস্থায় শহরবাসীর মনে প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বিপ্লব কুমার দেবের সেই প্রতিশ্রুতি শুধুই রাজনৈতিক চমক ছিল? রাজ্যের বর্তমান প্রশাসন কি হাওড়া নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি ও যৌবন ফিরিয়ে আনতে আদৌ কোনো উদ্যোগ নেবে? এসব প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হবে, ততদিন আগরতলাবাসীকে বর্ষার সময় জলাবদ্ধতা ও পানীয় জলের সংকটের মতো চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে।