রাজনৈতিক আশ্রয়ে ফুলেফেঁপে উঠছে গরু পাচার; বেপাত্তা গো-রক্ষক বাহিনী!
ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী এলাকায় গরু পাচার বানিজ্য এখন কোটি টাকার অবাধ কারবারের রূপ নিয়েছে। একসময় যাঁরা “গোমাতা রক্ষার” নামে রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন, আজ তাঁরা যেন উধাও। প্রশাসনের নিরব ভূমিকা, রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ জড়িত থাকার অভিযোগ এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ দানা বাঁধছে।
গরু পাচার ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তে ২৫ কোটি টাকারও বেশি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। সেই ঘটনা তোলপাড় তুলেছিল রাজ্য রাজনীতিতে। অথচ বিজেপি শাসিত ত্রিপুরাতেও অনুরূপ চিত্র উঠে এলেও এখানকার প্রশাসন কার্যত নিশ্চুপ। প্রশ্ন উঠছে, পশ্চিমবঙ্গে যদি এই ধরনের পাচারের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও রাজনীতি সরব হয়, তবে ত্রিপুরায় তা হবে না কেন?
প্রতিদিন কমলাসাগর ও বিশালগড় বিধানসভা কেন্দ্র হয়ে শত শত গরু বোঝাই গাড়ি ভারতের অভ্যন্তর থেকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাচার হচ্ছে। পুটিয়া, কামথানা ও রহিমপুর সীমান্তপথ হয়ে এই পাচার নিয়মিত চলছে বলে অভিযোগ। অথচ পুলিশ বা বিএসএফের তৎপরতা প্রায় শূন্য। এক সময়ের ‘গো রক্ষক বাহিনী’-র সদস্যদের এখন আর ময়দানে দেখা যায় না।
গোপন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বক্সনগর বিধানসভা কেন্দ্রের এক রাষ্ট্রবাদী নেতার ঘনিষ্ঠ সহযোগী দুলাল নামক এক চিহ্নিত পাচারকারী বর্তমানে এই পাচার বানিজ্যের মূল চালক। পুটিয়া, রহিমপুর এবং কামথানা সীমান্ত এলাকা তার নিয়ন্ত্রণে। প্রতি গাড়ি গরুর জন্য মোটা অঙ্কের ‘প্রণামী’ দিতে হয় দুলালকে, যার একাংশ নাকি বক্সনগরের “দাদা”-র পকেটেও যায়। অভিযোগ রয়েছে, দুলাল কার্যত সেই নেতার হয়ে কাজ করেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী, গরু পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকা মাফিয়াদের তিনটি স্তরে প্রণামী দিতে হয়।
- বিশালগড় এলাকার নেতাদের দিতে হয় মাসিক ৭ লক্ষ টাকা।
- কমলাসাগর এলাকার মন্ডল নেতারাও মাসে ৫ লক্ষ টাকা করে নেন এই ব্যবসা থেকে।
- খবরের প্রকাশ বাকি প্রণামী ভাগ করে নেন বক্সনগর নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ মহল।
স্থানীয়দের মধ্যে এই চক্র সম্পর্কে জানা থাকলেও কেউ মুখ খুলছেন না, কারণ ভয় এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আশঙ্কা প্রবল। গরু পাচার নিয়ে শাসকদলের অন্দরে স্পষ্টভাবে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। একাংশ নেতা-কর্মী প্রশ্ন তুলছেন—২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার আগে গরু রক্ষার নামে পথে নামা দল এখন কেন নিশ্চুপ? তখন বাইক মিছিল, গরু বোঝাই গাড়ি আটক, এমনকি সংঘর্ষে গাড়ি চালক আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। অথচ এখন প্রশাসন এবং দল দু’পক্ষই চোখের সামনে পাচার চললেও চুপচাপ দর্শকের ভূমিকা অবতীর্ণ।
এই নীরবতার পেছনে কোটি টাকার ‘প্রণামী ভাগ’ই কি দায়ী? স্থানীয়দের মতে, এই পাচার বানিজ্য থেকে যে মোটা টাকা আসে, তা থেকেই একাংশ নেতা রাতারাতি অর্থসম্পদে ফুলেফেঁপে উঠেছেন। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি এবং ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন বলে অভিযোগ।
দলের অভ্যন্তরেই এই ইস্যুতে সৃষ্টি হয়েছে গোষ্ঠী কোন্দল। একাধিক নেতা এই অবৈধ বানিজ্য বন্ধের দাবি তুলছেন। অন্যদিকে যারা এই কারবারে যুক্ত, তারা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দমনপীড়নের আশ্রয় নিচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে সংঘর্ষের আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। গো-রক্ষার নামে রাজনীতি করা দলকে আজ এই ইস্যুতেই ভেঙে পড়তে হতে পারে—এমন মতামত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।
ত্রিপুরার গরু পাচার ইস্যু এখন শুধু একটি সীমান্ত সমস্যা নয়, বরং তা রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবেশ, প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা এবং নৈতিকতার প্রশ্নে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন দেখার বিষয়, এই কোটি টাকার পাচারচক্রে প্রশাসন আদৌ পদক্ষেপ নেয় কি না, নাকি “প্রণামী” আর প্রভাবের জোরেই এই বানিজ্য চলতেই থাকবে।