সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি দল তিপ্রা মথার নাটকীয় অবস্থা!
তিপ্রা মথার যুব সংগঠনের ডাকে গোমতী জেলাজুড়ে সরকারি অফিস শাটডাউন ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠল মন্দির নগরী উদয়পুর। সোমবার সকাল থেকেই বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সংগঠনের বিপুল সংখ্যক কর্মী জেলাশাসকের কার্যালয় সহ একাধিক দপ্তরের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন। এর ফলে সরকারি পরিষেবা কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় গোমতী জেলায়। তিপ্রা মথার যুব সংগঠনের এই কর্মসূচি ছিল পূর্ব ঘোষিত। রবিবার রাত থেকেই গোটা গোমতী জেলায় প্রশাসন ছিল সর্বোচ্চ সতর্কতায়। জেলা শাসকের কার্যালয়ের সামনে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। মোতায়েন করা হয় রাজ্য পুলিশ, TSR এবং আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের। পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে উদয়পুর থানা এবং জেলা গোয়েন্দা শাখার আধিকারিকরা ছিলেন মাঠে।
তবে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যুব সংগঠনের কর্মীরা নিরাপত্তা বলয় ভাঙার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় ধাক্কাধাক্কি ও ধস্তাধস্তি হয়। যদিও প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, এখনও পর্যন্ত কোনো গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেনি এবং কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। এই উত্তেজনার পেছনে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে সংগঠনের সুপ্রিমো প্রদ্যোত কিশোর ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পর্ব। ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও এক প্রতিনিধি দল নিয়ে জেলাশাসকের সরকারি আবাসে সাক্ষাৎ করতে যান প্রদ্যোত, কিন্তু জেলাশাসক টি কে চাকমা রাতের বেলায় সাক্ষাৎ করতে অস্বীকার করেন। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও ক্ষোভ না জানালেও, মুখ্যমন্ত্রীকে এই ঘটনা সম্পর্কে অবগত করেন প্রদ্যোত নিজেই। তিনি জানান, এটি কোনো অভিযোগ নয়, শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রীকে পরিস্থিতি জানিয়েছেন মাত্র। মুখ্যমন্ত্রীও বিষয়টি যথাযথভাবে দেখার আশ্বাস দেন।
তবে ঘটনা মোড় নেয় এক ভিন্ন রাজনৈতিক বিতর্কের দিকে, যখন তিপ্রা মথার যুব সংগঠন সরকারে থেকে প্রশাসনের বিরুদ্ধেই সরাসরি বিদ্রোহে নামে। তিপ্রা মথা এখন আর বিরোধী দল নয়—রাজ্যের বর্তমান শাসক জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক। এমতাবস্থায় সরকারের অংশ হয়েও নিজ সরকারের প্রশাসনের বিরুদ্ধে এই ধরনের শক্তিশালী আন্দোলনে নামা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। বিরোধী দলের নেতারাও এই প্রসঙ্গে দ্বন্দ্বে পড়েন। প্রদ্যোতের সঙ্গে জেলাশাসকের সাক্ষাৎ না হওয়ায় বাম ও কংগ্রেস নেতারা প্রথমে প্রতিবাদে সরব হন, তাঁরা প্রকাশ্যে প্রদ্যুতের প্রতি ‘অসম্মান’ বলে কড়া ভাষায় প্রশাসনকে দোষারোপ করেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের অবস্থানে পরিবর্তন দেখা যায়। কারণ জনমানসে প্রশ্ন উঠেছে—সরকারের অংশীদার হয়ে কিভাবে তিপ্রা মথা প্রশাসনের বিরুদ্ধেই আন্দোলনে নামতে পারে?
একাংশের মতে, এটি তিপ্রা মথার মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ। শাসন ক্ষমতার অংশ হয়েও সংগঠনের একাংশ হয়তো নিজস্ব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে এভাবে রাস্তায় নামছে। অপরদিকে অন্য এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, এটা এক ধরনের ‘দূরত্বের রাজনীতি’, সরকারে থেকেও জনসমর্থন ধরে রাখার কৌশল। তবে কিছু সাধারণ মানুষের বক্তব্য রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলি নিয়ে তিপ্রা মথার পক্ষ থেকে কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা যায়নি কখনো। তার মানে প্রদ্যুৎ কিশোর ব্যস্ত শুধু সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজের স্বার্থ সিদ্ধিতে।
এই ঘটনাকে ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক মহলে। একদিকে প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভূমিকা ও জেলাশাসকের ‘অসংবেদনশীলতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, অন্যদিকে তিপ্রা মথার দ্বৈত ভূমিকা নিয়েও সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক মাধ্যমে। কেউ বলছেন, “সরকারে থাকলে সরকারের ভিতরেই কথা বলার সুযোগ থাকে, তাহলে রাস্তায় নামার প্রয়োজন কেন?” আবার কেউ বলছেন, “এটা রাজনীতির চরম দ্বিচারিতা, সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করা হচ্ছে।” তবে তিপ্রা মথা বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পক্ষ থেকে এই বিষয়ে এখনও কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তিপ্রা মথার তরফে আন্দোলন স্থগিত করা হয়নি বলেই জানা গেছে।
গোটা ঘটনায় একদিকে প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনের দায়িত্ববোধ ও রাজনৈতিক শালীনতা নিয়ে, অন্যদিকে শাসক দলের অংশীদার হয়ে সরকারের বিরুদ্ধেই রাজপথে নামার রাজনীতিরও নৈতিকতা নিয়ে। এই পরিস্থিতি যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তবে রাজ্যে প্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যে এক গভীর আস্থাহীনতার সংকট তৈরি হতে পারে বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। সার্বিক পরিস্থিতির দিকে এখন নজর রাখছে গোটা রাজ্য।