বিদ্যাব্যবসা বন্ধে জোরালো তৎপরতা

বিদ্যাব্যবসা বন্ধে জোরালো তৎপরতা!

বিদ্যাব্যবসার দায়ে বিলোনিয়ায় ১২ জন সরকারি শিক্ষকের মুচলেকা!

ত্রিপুরা রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি স্কুলে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রাইভেট টিউশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে এসেছে। বারংবার বিতর্ক, তর্ক-বিতর্ক, এমনকি হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও এই বিদ্যাব্যবসা বন্ধ হয়নি। এবার দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়া মহকুমায় সেই বিদ্যাব্যবসার বিরুদ্ধেই দৃঢ় পদক্ষেপ নিল জেলা শিক্ষা দপ্তর। সোমবার বিলোনিয়া মহকুমার অন্তর্গত রাজনগর ব্লকের বিভিন্ন স্কুলের ১২ জন শিক্ষককে ডেকে পাঠিয়ে টিউশন বানিজ্য না করার মুচলেকা আদায় করলেন বিলোনিয়া স্কুল পরিদর্শক। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষক মহল ও শিক্ষা প্রশাসনের অন্দরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

সরকারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রাইভেট টিউশন কতটা নৈতিক ও আইনসিদ্ধ, তা নিয়ে বহুদিন ধরেই বিতর্ক চলছিল। ত্রিপুরা হাইকোর্ট এই বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশও জারি করেছিল—সরকারি চাকরিতে থেকে প্রাইভেট টিউশন করা সম্পূর্ণরূপে বেআইনি। বিজেপি সরকারের আগের শিক্ষামন্ত্রী একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছিলেন। দক্ষিণ ও পশ্চিম জেলার প্রায় অর্ধ শতাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক সময় নোটিশও জারি হয়েছিল। রাজধানীর সাতটি স্কুলকে চিহ্নিত করে অন্তত ২৫ জন শিক্ষককে শোকজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি। ফলত, অধিকাংশ অভিযুক্ত শিক্ষক নির্ভয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের টিউশন বানিজ্য।

মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার মানিক সাহা নিজে বিদ্যাব্যবসা রুখতে চান বলে একাধিকবার জানিয়েছেন। এক সময় সিপাহিজলা জেলার জেলা শাসক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন ডাক্তার বিশাল কুমার এই বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাকে পশ্চিম জেলায় বদলি হতে হয়েছে, তারপর থেকে তিনি এই ব্যাপারে আর আগ্রহ ও তৎপরতা দেখাননি। এই পরিস্থিতিতে রাজনগর ব্লকের একাধিক বেকার শিক্ষিত যুবক ও গৃহশিক্ষক সম্প্রদায় শিক্ষা দপ্তরে লিখিত অভিযোগ জানান। তাদের দাবি—সরকারি শিক্ষকরা ক্লাস না নিয়ে বা স্কুল ফাঁকি দিয়ে ইনস্টিটিউট খুলে বাসাবাড়িতে টিউশন করাচ্ছেন। ফলে তারা চাকরির সুযোগ বা শিক্ষার্থীদের কাছে সম্মান—দুটো থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন।

অভিযোগের ভিত্তিতে বিলোনিয়া স্কুল পরিদর্শকের দপ্তর ১২ জন সরকারি শিক্ষককে নোটিশ পাঠিয়ে তলব করে। মঙ্গলবার দুপুরে ওই ১২ জনের মধ্যে ১১ জন হাজির হন এবং লিখিতভাবে জানান তারা প্রাইভেট টিউশন করেন না। তবে তারাও স্বীকার করেন যে একাংশ শিক্ষক এখনো প্রাইভেট টিউশন করে চলেছেন। এ পর্যন্ত সোনাপুর দ্বাদশ শ্রেণী বিদ্যালয়, বড়পাথরী দ্বাদশ শ্রেণী বিদ্যালয়, হরিপুর এসবি স্কুল, মনপাথর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, অজগর রহমানপুর উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নাসিরনগর উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ও বাগানবাড়ি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একাংশ শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।

বিলোনিয়া বিদ্যালয় পরিদর্শক স্বীকার করেছেন, “কিছু কিছু শিক্ষক প্রাইভেট টিউশন করছেন, এমন অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। আমরা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করবো এবং প্রয়োজনে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।” তবে এও স্পষ্ট যে এখনও পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ত্রিপুরা হাইকোর্ট সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন বন্ধে কড়া নির্দেশ দিলেও প্রশাসনিক স্তরে সেই নির্দেশ কার্যকর করতে গড়িমসি দেখা গিয়েছে। আজও বহু শিক্ষক দীর্ঘ বছর ধরে একই স্কুলে বদলিহীনভাবে চাকরি করে নিজেদের “প্রভাব” কাজে লাগিয়ে চুটিয়ে টিউশন বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যাব্যবসার রমরমা চলছে প্রায় খোলাখুলি। ভালো ফলাফলের আশায় অধিকাংশ অভিভাবক সরকারি স্কুলের পড়াশোনার তুলনায়, ঐ শিক্ষকদের কর্তৃক পরিচালিত প্রাইভেট শিক্ষক বা ইনস্টিটিউটকেই ভরসা করছেন। এর ফলেই শিক্ষিত বেকার যুবকদের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে। যেখানে আদালতের নির্দেশও কার্যকর হচ্ছে না, সেখানে একাংশ শিক্ষক “রাষ্ট্রবাদী”, “রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা”, এমনকি “বাম আন্দোলনের” প্রাক্তন সৈনিক হিসেবে নিজেদের আড়াল করছেন। এতদিন পর্যন্ত জেলা শিক্ষা অফিসারেরাও কার্যত নির্বিকার ছিলেন। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় সাধারণ মানুষ ও শিক্ষিত বেকাররা আস্থা হারাচ্ছেন।

বিলোনিয়ায় শিক্ষা দপ্তরের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসনীয়, তবে তা যথেষ্ট নয়। রাজ্য জুড়ে একটি জোরালো এবং নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রতিটি সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে না পারলে, আইনের শাসন প্রশ্নের মুখে পড়বে। একই সঙ্গে রাজ্য সরকারের উচিত বিদ্যাব্যবসা রোধে একটি নির্দিষ্ট বদলিনীতি চালু করা এবং শিক্ষকদের পেশাগত নৈতিকতার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো। জনগণের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে প্রশাসনিক হেলদোল শুরু হলেও এখনই বলা যাচ্ছে না—বিদ্যাব্যবসা সত্যিই বন্ধ হবে কিনা। সময়ই তার উত্তর দেবে।About Us