নিয়োগপ্রক্রিয়ায় প্রতারণা

নিয়োগপ্রক্রিয়ায় প্রতারণা!

নিয়োগপ্রক্রিয়ায় প্রতারণা ও কর্মসংস্থানের অভাবে পাহাড় ছাড়ছে তিপরাসারা!

ডাবল ইঞ্জিন এবং ত্রিপল ইঞ্জিনের সরকারের আমলেও রাজ্যের বেকার যুবসমাজের প্রতি প্রতারণার অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে শূন্য পদে নিয়োগের ঘোষণা করা হলেও, বছর পর বছর ধরে সেই প্রক্রিয়া ঝুলে থাকছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হলেও ফলাফল প্রকাশ হতে সময় লেগে যাচ্ছে দুই থেকে তিন বছর। তার পরেও নিয়োগ স্থগিত করা হচ্ছে বা বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে।

এই চিত্র বিশেষভাবে স্পষ্ট এডিসি (ADC) পরিচালিত দপ্তরগুলিতে। গত দুই-তিন বছরে একাধিক পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি হলেও অধিকাংশ পদে এখনও নিয়োগ হয়নি। ২০২৩ সালে এডিসি প্রশাসন মোট ৩৮টি জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, ২০টি পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও ২১টি এগ্রিকালচার অফিসার পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করে। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আরও ১১০টি সাব-জোনাল ডেভেলপমেন্ট অফিসার পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এইসব পদে আবেদন নেওয়া হয় অফলাইনে। আবেদনপত্র জমার সময় সাধারণ শ্রেণির প্রার্থীদের থেকে নেওয়া হয় ৫০০ টাকা এবং তপশিলি জাতি ও উপজাতি প্রার্থীদের থেকে ৩৫০ টাকা করে। এর ফলে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী তপ্ত রোদ ও গরমের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদন জমা দেন।

পরবর্তী সময়ে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও এগ্রিকালচার অফিসার পদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হলেও সাব-জোনাল অফিসার পদের পরীক্ষা ঘিরে দেখা দেয় একাধিক কেলেঙ্কারি। অভিযোগ, পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। এই ঘটনায় মথা সুপ্রিমো প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মণ নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক মাধ্যমে পরীক্ষা স্থগিতের দাবি তোলেন। পরবর্তীতে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। পুনরায় পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয় এবং লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়।

পরীক্ষার ফলাফল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রকাশ করা হলেও শুরু হয় নতুন বিতর্ক। ফলাফলের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরপর এডিসি প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, যাঁদের সন্দেহ আছে তাঁরা অফিসে গিয়ে মার্কশিট দেখতে পারবেন—এই সময়সীমা ছিল এক মাস। কিন্তু এরপরও সাত-আট মাস কেটে গেলেও ইন্টারভিউয়ের কোনও হদিশ নেই। চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, সাব-জোনাল অফিসার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিটি পদের জন্য চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ঘুষ দাবি করা হচ্ছে। অনেকের কাছে সরাসরি ঘুষের প্রস্তাবও এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

পরীক্ষা বাতিল হলেও কোথাও কোনও ফি ফেরতের প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। রাজ্য বিধানসভা থেকে শুরু করে ত্রিপুরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অনেক পরীক্ষাও বাতিল হয়েছে, কিন্তু কখনও ফি ফেরত দেওয়া হয়নি। আবেদন ফি আদায় করে বছরের পর বছর নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রাখার ফলে বেকারদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দিন দিন বেড়ে চলেছে।

এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের তিপরাসা যুবক-যুবতীরা কর্মসংস্থানের আশায় অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। কেউ দিনমজুর, কেউ দোকানে কর্মচারী, কেউ আবার ছোটখাটো হোটেলে কাজ করছেন। শুধু বাইরের রাজ্য নয়, আগরতলা শহরের নানা দোকানেও পাহাড়ি যুবকদের কর্মচারী হিসেবে দেখা যাচ্ছে। যাঁদের উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট রয়েছে, তাঁরাও এখন দিন হাজিরা খাটতে বাধ্য হচ্ছেন। এভাবে কর্মসংস্থানের অভাব ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্নীতিতে পাহাড়ি সমাজে এক ভয়াবহ সামাজিক সংকট তৈরি হয়েছে। একদিকে ভঙ্গুর প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, অন্যদিকে দীর্ঘসূত্রিতা ও ঘুষের বাজার—সব মিলিয়ে রাজ্যের শিক্ষিত বেকারদের ভবিষ্যৎ ধূসর হয়ে উঠেছে।

প্রশ্ন উঠছে—আর কত বছর লাগবে একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে? নিয়োগ পরীক্ষা শেষ, ফল প্রকাশও হয়ে গেছে। কিন্তু এরপরেও ইন্টারভিউ নয়, নিয়োগপত্র তো দূরের কথা—প্রক্রিয়া শেষ হবে কবে? যে চাকরির স্বপ্ন নিয়ে হাজার হাজার যুবক দিন কাটাচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চয়তার অন্ধকারে।About Us